আল্লাহ তা‘আলার আকার আছে, তিনি নিরাকার নন। নিরাকার অর্থ যা দেখে না, শুনে না। কিন্তু আল্লাহ সবকিছু দেখেন, শোনেন। তিনি এ বিশ্বজাহান ও সমস্ত সৃষ্টির একমাত্র স্রষ্টা, নিয়ন্তা ও পরিচালক। তিনি মানুষকে রিযিক দান করেন, রোগাক্রান্ত করেন ও আরোগ্য দান করেন। সুতরাং তাঁর আকার নেই, একথা স্বীকার করা তাঁর অস্তিত্বকে অস্বীকার করারই নামান্তর।
আল্লাহ শুনেন, দেখেন, উপকার-ক্ষতি, কল্যাণ-অকল্যাণ বিধান করেন। তিনি জীবন-মৃত্যুর মালিক, সকল সমস্যার একমাত্র সমাধানদাতা। সুতরাং মহান আল্লাহ নিরাকার নন; বরং তাঁর আকার আছে।
(১) আল্লাহ বলেন, لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيْعُ البَصِيْرُ. ‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (শূরা ৪২/১১)।
(২) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, إِنَّ اللهَ كَانَ سَمِيْعاً بَصِيْراً. ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (নিসা ৪/৫৮)।
(৩) অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘ওটা এজন্য যে, আল্লাহ রাত্রিকে প্রবিষ্ট করেন দিবসের মধ্যে এবং দিবসকে প্রবিষ্ট করেন রাত্রির মধ্যে এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সম্যক দ্রষ্টা’ (হজ্জ ২২/৬১)।
(৪) ‘হে নবী! তুমি বল, তারা কত কাল ছিল, আল্লাহই তা ভাল জানেন, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর অজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই। তিনি কত সুন্দর দ্রষ্টা ও শ্রোতা’ (কাহফ ১৮/২৬)। ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন, ‘সমস্ত সৃষ্টজীবকে আল্লাহ তা‘আলা দেখেন ও তাদের সকল কথা শুনেন। তাঁর নিকট কোন কিছুই গোপন থাকে না’।[13]
ক্বাতাদা (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর থেকে কেউ বেশী দেখেন না ও শুনেন না’।[14] ইবনু যায়েদ (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টজীবের সকল কাজকর্ম দেখেন এবং তাদের সকল কথা শুনেন। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’।[15]
বাগাবী (রহঃ) বলেন, ‘সমস্ত সৃষ্টজীব যেখানেই থাকুক না কেন আল্লাহ তা‘আলা তাদের দেখেন এবং তাদের সর্বপ্রকার কথা শ্রবণ করেন। তাঁর দেখার ও শুনার বাইরে কোন কিছুই নেই’।[16]
(৫) আল্লাহ তা‘আলা মূসা ও হারূণ (আঃ)-কে লক্ষ্য করে বলেন, لاَ تَخَافَا إِنَّنِيْ مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَى ‘তোমরা ভয় করো না, আমি তো তোমাদের সঙ্গে আছি, আমি শুনি ও আমি দেখি’ (ত্ব-হা ২০/৪৬)। এখানে আল্লাহ মূসা ও হারূণের সাথে থাকার অর্থ হচ্ছে- তিনি আরশের উপর সমাসীন। আর মূসা ও হারূণ (আঃ)-এর উভয়ের সাথে আল্লাহর সাহায্য রয়েছে এবং তিনি তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করছেন।
(৬) আল্লাহ আরো বলেন, ‘কখনই নয়, অতএব তোমরা উভয়ে আমার নিদর্শন সহ যাও, আমি তো তোমাদের সঙ্গে আছি, আমি শ্রবণকারী’ (শু‘আরা ২৬/১৫)। পূর্বোক্ত ব্যাখ্যাই এখানে প্রযোজ্য।
(৭) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তারা কি মনে করে যে, আমি তাদের গোপন বিষয় ও গোপন পরামর্শের খবর রাখি না? অবশ্যই রাখি। আমার ফেরেশতারা তো তাদের নিকট অবস্থান করে সবকিছু লিপিবদ্ধ করেন’ (যুখরুফ ৪৩/৮০)।
(৮) আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! তুমি বলে দাও, তোমরা কাজ করতে থাক, আল্লাহ তো তোমাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করবেন’ (তওবা ৯/১০৫)।
(৯) আল্লাহ বলেন, ‘সে কি অবগত নয় যে, আল্লাহ দেখেন’? (আলাক্ব ৯৬/১৪)।
(১০) আল্লাহ বলেন, ‘যিনি তোমাকে দেখেন যখন তুমি (ছালাতের জন্য) দন্ডায়মান হও এবং দেখেন সিজদাকারীদের সাথে তোমার উঠাবসা। তিনি তো সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ (শু‘আরা ২৬/২১৮-২২০)।
(১১) আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ তাদের কথা শ্রবণ করেছেন, যারা বলে যে, আল্লাহ দরিদ্র আর আমরা ধনী। তারা যা বলেছে তা এবং অন্যায়ভাবে তাদের নবীদের হত্যা করার বিষয় আমি লিপিবদ্ধ করব এবং বলব, তোমরা দহন যন্ত্রণা ভোগ কর’ (আলে ইমরান ৩/১৮১)।
(১২) আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই শুনেছেন সেই নারীর কথা, যে তার স্বামীর বিষয়ে তোমার সাথে বাদানুবাদ করছে এবং আল্লাহর নিকটও ফরিয়াদ করছে। আল্লাহ তোমাদের কথোপকথন শুনেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (মুজাদালাহ ৫৮/১)।
(১৩) আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছাহাবাদেরকে বলেছিলেন, فَإِنَّكُمْ لاَ تَدْعُوْنَ أَصَمَّ وَلاَ غَائِبًا ، تَدْعُوْنَ سَمِيْعًا بَصِيْرًا قَرِيْبًا. ‘তোমরা বধির কিংবা অনুপস্থিতকে ডাকছ না; বরং তোমরা ডাকছ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা ও নিকটতমকে’।[17]
(১৪) আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
اِجْتَمَعَ عِنْدَ الْبَيْتِ ثَقَفِيَّانِ وَقُرَشِيٌّ أَوْ قُرَشِيَّانِ وَثَقَفِيٌّ كَثِيْرَةٌ شَحْمُ بُطُوْنِهِمْ قَلِيْلَةٌ فِقْهُ قُلُوْبِهِمْ فَقَالَ أَحَدُهُمْ أَتَرَوْنَ أَنَّ اللهَ يَسْمَعُ مَا نَقُوْلُ قَالَ الْآخَرُ يَسْمَعُ إِنْ جَهَرْنَا وَلاَ يَسْمَعُ إِنْ أَخْفَيْنَا وَقَالَ الْآخَرُ إِنْ كَانَ يَسْمَعُ إِذَا جَهَرْنَا فَإِنَّهُ يَسْمَعُ إِذَا أَخْفَيْنَا فَأَنْزَلَ اللهُ تَعَالَى : وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَتِرُوْنَ أَنْ يَشْهَدَ عَلَيْكُمْ سَمْعُكُمْ وَلاَ أَبْصَارُكُمْ وَلاَ جُلُوْدُكُمْ وَنَجَّيْنَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ.
‘একদিন বায়তুল্লাহর নিকট একত্রিত হ’ল দু’জন ছাকাফী ও একজন কুরাইশী অথবা দু’জন কুরাইশী ও একজন ছাকাফী। তাদের পেটে চর্বি ছিল বেশি, কিন্তু তাদের অন্তরে বুঝার ক্ষমতা ছিল কম। তাদের একজন বলল, আমরা যা বলছি আল্লাহ তা শুনেন- এ ব্যাপারে তোমার অভিমত কি? দ্বিতীয়জন বলল, আমরা জোরে বললে শুনেন, কিন্তু চুপি চুপি বললে শুনেন না। তৃতীয়জন বলল, যদি তিনি জোরে বললে শুনেন, তাহ’লে গোপনে বললেও শুনেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আয়াত নাযিল করেন, ‘তোমরা কিছু গোপন করতে না এই বিশ্বাসে যে, তোমাদের কর্ণ, চক্ষু এবং ত্বক তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে না- উপরন্তু তোমরা মনে করতে যে, তোমরা যা করতে তার অনেক কিছুই আল্লাহ জানেন না’।[18]
(১৫) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (হজ্জ ২২/৭৫)।
আবু দাঊদ (রহঃ) বলেন, ‘এ আয়াতটিই হচ্ছে জাহমিয়্যাহ সম্প্রদায়ের বাতিল কথার প্রত্যুত্তর। কেননা জাহমিয়্যাহ সম্প্রদায় আল্লাহর নাম ও গুণবাচক নাম কোনটাই সাব্যস্ত করে না। সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা যে দেখেন-শুনেন এটাও সাব্যস্ত করে না এ ধারণায় যে, সৃষ্টির সাথে আল্লাহর সাদৃশ্য হবে। তাদের এ ধারণা বাতিল। এজন্য যে, তারা আল্লাহকে মূর্তির সাথে সাদৃশ্য করে দিল। কারণ মূর্তি শুনে না এবং দেখেও না (মা‘আরিজুল কবূল, ১/৩০০-৩০৪)।
মু‘তাযিলা সম্প্রদায় বলে, আল্লাহর কর্ণ আছে কিন্তু শুনেন না, চক্ষু আছে কিন্তু দেখেন না। এভাবে তারা আল্লাহর সমস্ত গুণকে অস্বীকার করে। অর্থাৎ কোন গুণ-বৈশিষ্ট্য ছাড়া তারা শুধু নামগুলো সাব্যস্ত করে। প্রকৃতপক্ষে তাদের মতবাদ জাহমিয়্যাদের মতবাদের ন্যায়। তাদের উভয় মতবাদই কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী। পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত কোন কিছুর সাথে তুলনা ব্যতিরেকে আল্লাহর ছিফাত সাব্যস্ত করে ঠিক সেভাবেই, যেভাবে কুরআন-হাদীছ সাব্যস্ত করে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (শূরা ৪২/১১)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ‘সুতরাং তোমরা আল্লাহর কোন সাদৃশ্য স্থির করো না’ (নাহল ১৬/৭৪)। আল্লাহ তা‘আলা যে শুনেন, দেখেন, এটা কোন সৃষ্টির শুনা, দেখার সাথে তুলনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহর দেখা-শুনা তেমন, যেমন তাঁর জন্য শোভা পায়। এ দেখা-শুনা সৃষ্টির দেখা-শুনার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়’।[19]
আল্লাহর সাথে সৃষ্টজীবের সাদৃশ্য করা হারাম। কারণ (১) আল্লাহর যাত-ছিফাত তথা আল্লাহ তা‘আলার সত্তা ও গুণ-বৈশিষ্ট্য এবং সৃষ্টজীবের গুণ-বৈশিষ্ট্য এক নয়। প্রত্যেকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, সেটা তার জন্যই প্রযোজ্য। আল্লাহ তা‘আলা সর্বদা জীবিত আছেন ও থাকবেন। কিন্তু সৃষ্টিকুলকে মৃত্যুবরণ করতেই হবে। তাহলে কি করে আল্লাহর সাথে সৃষ্টজীবের তুলনা করা যায়?
(২) সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য করায় সৃষ্টিকর্তার মান-ইয্যত নষ্ট হয়। ত্রুটিযুক্ত সৃষ্টজীবের সঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ মহান আল্লাহকে তুলনা করা হ’লে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ত্রুটিযুক্ত করা হয়।
(৩) স্রষ্টা ও সৃষ্টজীবের নাম-গুণ আছে। কিন্তু উভয়ের প্রকৃতি এক নয়।
আল্লাহ তা‘আলার আকার আছে, তিনি নিরাকার নন। তিনি শুনেন, দেখেন এবং তাঁর হাত, পা, চেহারা, চোখ ইত্যাদি আছে।
আল্লাহর হাত :
আল্লাহর আকার আছে, এর অন্যতম প্রমাণ হ’ল তাঁর হাত আছে। এ সম্পর্কে নিম্নে দলীল পেশ করা হ’ল-
(১) মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইহুদীদের একটি বক্তব্য এভাবে তুলে ধরেছেন, وَقَالَتِ الْيَهُوْدُ يَدُ اللهِ مَغْلُوْلَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيْهِمْ وَلُعِنُوْا بِمَا قَالُوْا بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوْطَتَانِ- ‘আর ইহুদীরা বলে, আল্লাহর হাত রুদ্ধ; তাদের হাতই বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের এ উক্তির দরুণ তাদের প্রতি অভিশাপ করা হয়েছে; বরং তাঁর (আল্লাহর) উভয় হাত প্রসারিত’ (মায়েদাহ ৬৪)।
(২) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, تَبَارَكَ الَّذِيْ بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ– ‘বরকতময় তিনি, যাঁর হাতে সর্বময় কর্তৃত্ব, তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান’ (মুলক ১)।
(৩) তিনি আরো বলেন, بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ– ‘আপনারই হাতে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই আপনি সব বিষয়ে ক্ষমতাবান’ (আলে ইমরান ২৬)।
(৪) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَدُ اللهِ فَوْقَ أَيْدِيْهِمْ ‘আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর’ (ফাতহ ১০)।
(৫) আল্লাহ বলেন, ‘তারা আল্লাহর যথোচিত সম্মান করে না। ক্বিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোতে এবং আকাশ সমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে’ (যুমার ৬৭)।
এ আয়াতের তাফসীরে ছহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে, ইহুদীদের একজন বড় আলেম রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল, يَا مُحَمَّدُ إِنَّا نَجِدُ أَنَّ اللهَ يَجْعَلُ السَّمَوَاتِ عَلَى إِصْبَعٍ وَالْأَرَضِيْنَ عَلَى إِصْبَعٍ وَالشَّجَرَ عَلَى إِصْبَعٍ وَالْمَاءَ وَالثَّرَى عَلَى إِصْبَعٍ وَسَائِرَ الْخَلَائِقِ عَلَى إِصْبَعٍ فَيَقُوْلُ أَنَا الْمَلِكُ، فَضَحِكَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى بَدَتْ نَوَاجِذُهُ تَصْدِيْقًا لِقَوْلِ الْحَبْرِ. ‘হে মুহাম্মাদ! আমরা (তাওরাতে) এটা লিখিত পাচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা সপ্ত আকাশ রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর এবং
(* এম.এ (শেষ বর্ষ), দাওয়াহ ও উছূলুদ্দীন অনুষদ, আক্বীদা বিভাগ, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।)
যমীনগুলো রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর, বৃক্ষরাজিকে রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর এবং পানি ও মাটি রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর, আর সমস্ত মাখলূককে রাখবেন এক আঙ্গুলের উপর। অতঃপর তিনি বলবেন, আমিই সবকিছুর মালিক ও বাদশা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইহুদী আলেমের কথার সত্যতায় হেসে ফেলেন, এমনকি তার মাড়ির দাঁত প্রকাশিত হয়ে পড়ে। অতঃপর তিনি উপরোক্ত আয়াতটি পাঠ করেন।[20]
(৬) ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ اللهَ يَقْبِضُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْأَرْضَ وَتَكُوْنُ السَّمَاوَاتُ بِيَمِيْنِهِ ثُمَّ يَقُوْلُ أَنَا الْمَلِكُ. ‘আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন সমস্ত পৃথিবীকে তাঁর মুঠোতে ধারণ করবেন এবং সমস্ত আকাশকে স্বীয় ডান হাতে গুটিয়ে নিয়ে বলবেন, আমিই একমাত্র বাদশাহ’।[21]
(৭) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
إِنَّ اللهَ تَعَالَى يَبْسُطُ يَدَهُ بِاللَّيْلِ لَيِتُوْبَ مُسِئُ النَّهَارِ، وَيَبْسُطُ يَدَهُ بِالنَّهَارِ لِيَتُوْبَ مُسِئُ اللَّيْلِ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا-
‘আল্লাহ তা‘আলা পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় না হওয়া পর্যন্ত (ক্বিয়ামত পর্যন্ত) প্রতি রাতে তাঁর হাত প্রসারিত করতে থাকবেন, যাতে করে দিনের গুনাহগার তওবা করে। আর তিনি দিনে তাঁর হাত প্রসারিত করতে থাকবেন, যাতে করে রাতের গুনাহগার তওবা করে’।[22]
(৮) শাফা‘আত সংক্রান্ত হাদীছে আছে, হাশরবাসী আদম (আঃ)-এর কাছে এসে বলবে, يَا أَدَمُ أَنْتَ أَبُو الْبَشَرِ، خَلَقَكَ اللهُ بِيَدِهِ، ‘হে আদম! আপনি মানুষের পিতা। আল্লাহ আপনাকে তাঁর নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন’।[23]
(৯) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَا إِبْلِيْسُ مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ- ‘হে ইবলীস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি, তার প্রতি সিজদাবনত হ’তে তোমাকে কিসে বাধা দিল?’ (ছোয়াদ ৭৫)।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সবাই ঐক্যমত যে, আল্লাহ তা‘আলার উভয় হাতই প্রকৃত। এখানে সঠিক অর্থ বাদ দিয়ে কুদরতী হাত, অনুগ্রহ, শক্তি এসব অর্থ গ্রহণ করা যাবে না কয়েকটি কারণে। যেমন-
(ক) প্রমাণ ছাড়া প্রকৃত অর্থকে পরিবর্তন করে রূপকার্থ নেয়া বাতিল।
(খ) সূরা ছোয়াদের ৭৫নং আয়াতে হাতের সম্বন্ধ করা হয়েছে আল্লাহর দিকে দ্বিবচনের শব্দ দ্বারা(بصيغة الةثنية)। পক্ষান্তরে কুরআন এবং সুন্নাহর কোথাও নে‘মত ও শক্তির সম্বন্ধ আল্লাহর দিকে দ্বিবচন দ্বারা করা হয়নি। সুতরাং প্রকৃত হাতকে নে‘মত ও কুদরতী অর্থে ব্যাখ্যা করা শুদ্ধ ও সঠিক নয়।
(১০) আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ قُلُوْبَ بَنِيْ آدَمَ كُلَّهَا بَيْنَ إِصْبَعَيْنِ مِنْ أَصَابِعِ الرَّحْمَنِ كَقَلْبٍ وَاحِدٍ يُصَرِّفُهُ حَيْثُ يَشَاءُ. ‘নিশ্চয়ই সকল আদম সন্তানের অন্তর সমূহ একটি অন্তরের ন্যায় আল্লাহ তা‘আলার আঙ্গুল সমূহের দু’টি আঙ্গুলের মাঝে অবস্থিত। তিনি যেমন ইচ্ছা তা পরিচালনা করেন’।[24]
(১১) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
مَنْ تَصَدَّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِّنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ وَلاَيَقْبَلُ اللهُ إِلاَّ الطَّيِّبَ، وَإِنَّ اللهَ يَتَقَبَّلُهَا بِيَمِيْنِهِ، ثُمَّ يُرَبِّيْهَا لِصَاحِبِهِ كَمَا يُرَبِّيْ أَحَدُكُمْ فَلُوَّهُ حَتَّى تَكُوْنَ مِثْلَ الْجَبَلِ-
‘যে তার হালাল রোযগার থেকে একটি খেজুর পরিমাণ দান করবে (আল্লাহ তা কবুল করবেন) এবং আল্লাহ হালাল বস্ত্ত ছাড়া কিছুই গ্রহণ করেন না। আর আল্লাহ তা তাঁর ডান হাতে গ্রহণ করবেন। অতঃপর তার দানকারীর জন্য তা প্রতিপালন করতে থাকেন যেরূপ তোমাদের কেউ তার অশ্ব-শাবককে লালন-পালন করতে থাকে। অবশেষে একদিন তা পাহাড় সমতুল্য হয়ে যায়’।[25]
(১২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يَقُوْلُ اللهُ يَا آدَمُ فَيَقُوْلُ لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ فِيْ يَدَيْكَ قَالَ يَقُوْلُ أَخْرِجْ بَعْثَ النَّارِ-‘আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে বলবেন, হে আদম! উত্তরে তিনি বলবেন, হাযির হে প্রতিপালক! আমি সৌভাগ্যবান এবং সমস্ত কল্যাণ আপনার হাতে। তিনি বলবেন, জাহান্নামীদেরকে বের করে দাও’।[26]
আল্লাহর পা :
আল্লাহ তা‘আলার পা মোবারক সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَيَزَالُ يُلْقَى فِيْهَا وَتَقُوْلُ هَلْ مِنْ مَّزِيْدٍ حَتَّى يَضَعَ فِيْهَا رَبُّ الْعَالَمِيْنَ قَدَمَهُ فَيَنْزَوِىْ بَعْضُهَا إِلَى بَعْضٍ ثُمَّ تَقُوْلُ قَدْ قَدْ بِعِزَّتِكَ وَكَرَمِكَ- ‘জাহান্নামে (জাহান্নামীদের) নিক্ষেপ করা হ’তে থাকবে আর সে (জাহান্নাম) বলবে, আরো আছে কি? শেষ পর্যন্ত বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক তাতে পা রাখবেন। তাতে জাহান্নামের একাংশের সাথে আরেকাংশ মিশে যাবে। অতঃপর জাহান্নাম বলবে, তোমার প্রতিপত্তি ও মর্যাদার শপথ! যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে’।[27]
এতদ্ব্যতীত আল্লাহর পদনালীর বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ বলেন, يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ وَّيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُوْدِ فَلاَيَسْتَطِيْعُوْنَ- ‘সেদিন পায়ের নলা উন্মোচিত করা হবে এবং তাদেরকে (কাফিরদেরকে) আহবান করা হবে সিজদা করার জন্য কিন্তু তারা তা করতে পারবে না’ (কলম ৪২)।
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
يَكْشِفُ رَبُّنَا عَنْ سَاقٍ فَيَسْجُدُ لَهُ كُلُّ مُؤْمِنٍ وَّمُؤْمِنَةٍ فَيَبْقَى كُلُّ مَنْ كَانَ يَسْجُدُ فِى الدُّنْيَا رِيَاءً وَّسُمْعَةً فَيَذْهَبُ لِيَسْجُدَ فَيَعُوْدُ ظَهْرُهُ طَبَقًا وَّاحِدًا-
‘(ক্বিয়ামতের দিন) আমাদের প্রভু পায়ের নলা উন্মুক্ত করে দিবেন। অতঃপর সকল মুমিন পুরুষ ও নারী তাকে সিজদা করবে। কিন্তু বাকী থাকবে ঐসব লোক, যারা দুনিয়ায় সিজদা করত লোক দেখানো ও প্রচারের জন্য। তারা সিজদা করার জন্য যাবে, কিন্তু তাদের পৃষ্ঠদেশ একখন্ড তক্তার মত শক্ত হয়ে যাবে’।[28]
আল্লাহর চেহারা :
আল্লাহর চেহারা আছে, যা কুরআন ও হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত।
১. আল্লাহ বলেন, فَأَيْنَمَا تُوَلُّوْا فَثَمَّ وَجْهُ اللهِ- ‘তোমরা যে দিকেই মুখ ফিরাও সে দিকেই আল্লাহর মুখমন্ডল রয়েছে’ (বাক্বারাহ ১১৫)।
২. অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ وَّيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُوا الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ- ‘ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংসশীল। একমাত্র আপনার মহিমাময় ও মহানুভব পালনকর্তার চেহারা ব্যতীত’ (আর-রহমান ২৬-২৭)।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তা‘আলার মুখমন্ডলের সাথে সৃষ্টির মুখমন্ডলের সাদৃশ্য স্থাপন করা যাবে না।
আল্লাহর চোখ :
আল্লাহ তা‘আলার আকারের অন্যতম দলীল হচ্ছে তাঁর চক্ষু আছে। এ সম্পর্কে কুরআন-হাদীছ থেকে কতিপয় দলীল পেশ করা হ’ল-
(১) তিনি বলেন, تَجْرِيْ بِأَعْيُنِنَا جَزَاءً لِّمَنْ كَانَ كُفِرَ ‘যা আমার চোখের সামনে চালিত, এটা পুরস্কার তার জন্য, যে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল’ (ক্বামার ১৪)।
(২) তিনি আরো বলেন, وَلِتُصْنَعَ عَلَى عَيْنِيْ ‘যাতে তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও’ (ত্ব-হা ৩৯)।
(৩) আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ لَيْسَ بِأَعْوَرَ، أَلاَ إِنَّ الْمَسِيْحَ الدَّجَّالَ أَعْوَرُ الْعَيْنِ الْيُمْنَى كَأَنَّ عَيْنَهُ عِنَبَةٌ طَافِيَةٌ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অন্ধ নন। সাবধান! নিশ্চয়ই দাজ্জালের ডান চোখ কানা। তার চোখটা যে একটি ফুলে যাওয়া আঙ্গুরের মতো’।[29] সুতরাং কুরআন হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলার প্রকৃতই চোখ আছে। আর এটাকে সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য করা যাবে না।
আল্লাহর হাসি ও আনন্দ :
আল্লাহ তা‘আলার আনন্দ প্রকাশ ও হাসি সম্পর্কিত বর্ণনা হাদীছে এসেছে। আল্লাহর আনন্দ সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন,
لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحاً بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ حِيْنَ يَتُوْبُ إِلَيْهِ مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ عَلَى رَاحِلَتهِ بِأَرْضٍ فَلاَةٍ، فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُهُ وَشَرَابُهُ فأَيِسَ مِنْهَا، فَأَتَى شَجَرَةً فَاضْطَجَعَ فِيْ ظِلِّهَا وَقَدْ أَيِسَ مِنْ رَاحِلَتِهِ، فَبَيْنَمَا هُوَ كَذَلِكَ إِذْ هُوَ بِهَا قَائِمَةً عِنْدَهُ، فَأَخَذَ بِخِطَامِهَا، ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّةِ الفَرَحِ : اللَّهُمَّ أَنْتَ عَبْدِيْ وَأَنَا رَبُّكَ! أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الفَرَحِ-
‘আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার তওবার কারণে ঐ ব্যক্তির চেয়ে অধিক আনন্দিত হন, যে মরুভূমিতে রয়েছে, তার বাহনের উপরে তার খাদ্য-পানীয় রয়েছে, এসবসহ তার বাহনটি পালিয়ে গেল। সে নিরাশ হয়ে একটি গাছের ছায়ায় এসে শুয়ে পড়ল। এভাবে সময় কাটতে লাগল। এমন সময় সে তার পাশেই তাকে দন্ডায়মান দেখে তার লাগাম ধরে ফেলল। অতঃপর অত্যধিক আনন্দে বলে ফেলল, হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা, আমি তোমার রব। সে আনন্দের আতিশয্যে ভুল করে ফেলে’।[30]
আল্লাহ তা‘আলার হাসি সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন,
يَضْحَكُ اللهُ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى إِلَى رَجُلَيْنِ يَقْتُلُ أَحَدُهُمَا الْآخَرَ يَدْخُلاَنِ الْجَنَّةَ، يُقَاتِلُ هَذَا فِيْ سَبيْلِ اللهِ فَيُقْتَلُ، ثُمَّ يَتُوْبُ اللهُ عَلَى القَاتِلِ فَيُسْتَشْهَدُ–
‘আল্লাহ তা‘আলা দু’ব্যক্তির কর্ম দেখে হাসেন। এদের একজন অপর জনকে হত্যা করে। অবশেষে তারা উভয়ে জান্নাতে প্রবেশ করে। একজন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে নিহত হয়। অতঃপর হত্যাকারী আল্লাহর নিকট তওবা করে। এরপর সে শাহাদতবরণ করে’।[31]
মুমিনগণের আল্লাহ্কে দেখা :
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা হ’ল- আল্লাহর আকার আছে এবং প্রত্যেক জান্নাতবাসী ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ্কে স্বীয় আকৃতিতে দেখতে পাবে। মহান আল্লাহ বলেন, وُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ نَّاضِرَةٌ، إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ، ‘সেদিন অনেক মুখমন্ডল উজ্জ্বল হবে। তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে’ (ক্বিয়ামাহ ২২, ২৩)।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফিয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ঐ দিন এমন হবে যাদের মুখমন্ডলে উজ্জ্বলতা প্রকাশ পাবে। তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে।[32] যেমন ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত আছে, إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ عِيَانًا ‘শীঘ্রই তোমাদের প্রতিপালককে তোমরা চাক্ষুসভাবে দেখতে পাবে’।[33] অন্য হাদীছে এসেছে, লোকেরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ‘ক্বিয়ামতের দিন কি আমরা আমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাব? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উত্তরে বললেন, পূর্ণিমা রাতে চাঁদ দেখতে কি তোমাদের কোন কষ্ট হয়? তারা বলল, না, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি আরো বললেন, যখন আকাশ মেঘশূন্য ও সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকে তখন সূর্য দেখতে তোমাদের কোন কষ্ট হয় কি? উত্তরে তাঁরা বললেন, জ্বী না। তখন তিনি বললেন, এভাবেই তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাবে।[34]
ছহীহ মুসলিমে ছুহায়েব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, জান্নাতীরা যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, তোমাদের জন্য আমি আরো কিছু বৃদ্ধি করে দিই তা তোমরা চাও কি? তারা উত্তরে বলবে, আপনি কি আমাদের মুখমন্ডল উজ্জ্বল করেননি, আমাদেরকে জান্নাতে প্রবিষ্ট করেননি এবং আমাদেরকে জাহান্নাম হ’তে রক্ষা করেননি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, অতঃপর পর্দা সরে যাবে। তখন ঐ জান্নাতীদের দৃষ্টি তাদের প্রতিপালকের প্রতি পতিত হবে এবং তাতে তারা যে আনন্দ পাবে তা অন্য কিছুতেই পাবে না’। এই দীদারে বারী তা‘আলাই হবে তাদের নিকট সবচেয়ে প্রিয়। এটাকেই অতিরিক্ত বলা হয়েছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেন, لِلَّذِيْنَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَى وَزِيَادَةٌ، ‘সৎ কর্মশীলদের জন্য রয়েছে জান্নাত এবং তার চেয়েও বেশী’ (ইউনুস ২৬)।[35]
যারা আল্লাহ্কে দেখার বিষয়টি অস্বীকার করে তাদের দলীল হ’ল নিম্নোক্ত আয়াত, وَلَمَّا جَاءَ مُوْسَى لِمِيْقَاتِنَا وَكَلَّمَهُ رَبُّهُ قَالَ رَبِّ أَرِنِىْ أَنْظُرْ إِلَيْكَ، قَالَ لَنْ تَرَاِنِىْ، ‘মূসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হ’ল, তখন তাঁর প্রতিপালক তাঁর সাথে কথা বললেন, তিনি তখন বললেন, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে দর্শন দাও, আমি তোমাকে দেখব, তখন আল্লাহ বললেন, তুমি আমাকে আদৌ দেখতে পাবে না’ (আ‘রাফ ১৪৩)।
এখানে আল্লাহ لَنْ تَرَانِىْ দ্বারা না দেখার কথা বলেছেন। আর আরবী ব্যাকরণে لَنْ শব্দটি চিরস্থায়ী অস্বীকৃতি বুঝানোর জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। এই আয়াতকে দলীল হিসাবে নিয়ে মু‘তাযিলা সম্প্রদায় বলে থাকে যে, দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানেই আল্লাহকে দেখা অসম্ভব। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত মু‘তাযিলাদের জবাবে বলে থাকেন, এখানে আল্লাহ لَنْ تَرَانِىْ দ্বারা দুনিয়াতে না দেখার কথা বলেছেন, আখিরাতে নয়। কারণ কুরআন-হাদীছের দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ক্বিয়ামতের দিন মুমিন বান্দাগণ আল্লাহকে দেখতে পাবে। মূসা (আঃ) আল্লাহকে দুনিয়াতে দেখতে চেয়েছিলেন। অথচ দুনিয়ার এই চোখ দ্বারা আল্লাহকে দেখা সম্ভব নয়।
আল্লাহ তা‘আলার আকার সম্পর্কে ইমামগণের মতামত :
(১) ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলার ছিফাত-এর সাথে সৃষ্টজীবের ছিফাতকে যেন সাদৃশ্য করা না হয় এবং আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতের মধ্যে দু’টি ছিফাত হচ্ছে- তাঁর রাগ ও সন্তুষ্টি। রাগ ও সন্তুষ্টি কেমন একথা যেন না বলা হয়। এটাই হচ্ছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের কথা। তাঁর রাগকে শাস্তি এবং সন্তুষ্টিকে যেন নেকী না বলা হয়। আমরা তাঁর ছিফাত সাব্যস্ত করব। যেমনভাবে তিনি নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন। তিনি একক ও অদ্বিতীয়, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি কাউকে জন্ম দেননি ও তাঁকেও জন্ম দেওয়া হয়নি এবং কেউই তাঁর সমকক্ষ নয়। তিনি জীবিত, সবার উপর ক্ষমতাবান। তিনি শুনেন, দেখেন, সব বিষয় তাঁর জানা। আল্লাহর হাত তাদের সবার হাতের উপর। আল্লাহর হাত সৃষ্টির হাতের মত নয় এবং তাঁর মুখমন্ডল সৃষ্টির মুখমন্ডলের মত নয়।[36]
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) আরো বলেন, وله يد ووجه ونفس كما ذكره الله تعالى في القرآن فما ذكره الله تعالى في القرآن من ذكر الوجه واليد والنفس فهو له صفات بلا كيف ولا يقال إن يده قدرته أو نعمته لأن فيه إبطال الصفة وهو قول أهل القدر والاعتزال ولكن يده صفته بلا كيف وغضبه ورضاه صفتان من صفات الله تعالى بلا كيف. ‘তাঁর (আল্লাহর) হাত, মুখমন্ডল এবং নফস রয়েছে। যেমনভাবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে আল্লাহ তাঁর মুখমন্ডল, হাত ও নফসের যে কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলো তাঁর গুণ। কিন্তু কারো সাথে সেগুলোর সাদৃশ্য নেই। আর একথা বলা যাবে না যে, তাঁর হাত অর্থ তাঁর কুদরত বা নে‘মত। কেননা এতে আল্লাহর গুণকে বাতিল সাব্যস্ত করা হয়। আর এটা ক্বাদারিয়া ও মু‘তাযিলাদের মত। বরং তাঁর হাত তাঁর গুণ কারো হাতের সাথে সাদৃশ্য ব্যতীত। আর তাঁর রাগ ও সন্তুষ্টি কারো রাগ ও সন্তুষ্টির সাথে সাদৃশ্য ব্ ব্্যতীত আল্লাহর দু’টি ছিফাত বা গুণ।[37]
ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-কে আল্লাহ তা‘আলার অবতরণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা যে রাত্রের তৃতীয় অংশে সপ্ত আকাশে নেমে আসেন, এ নেমে আসাটা কেমন, কিভাবে নামেন, এটা বলার ক্ষমতা কাউকে দেওয়া হয়নি। কেমন করে নামেন এটা আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।[38]
আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতের সাথে মানুষের অর্থাৎ সৃষ্টির গুণের সাদৃশ্য হবে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা জানেন। কিন্তু সৃষ্টির জানা তাঁর মত নয়। তাঁর ক্ষমতা-শক্তি সৃষ্টির ক্ষমতার মত নয়। তাঁর দেখা-শুনা, কথা বলা, মানুষের বা সৃষ্টির দেখা-শুনা বা কথা বলার মত নয়।[39]
সুতরাং কুরআন-হাদীছে যেভাবে আল্লাহর গুণাবলী বর্ণিত আছে ঠিক সেভাবেই বলতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, ‘তিনি আরশের উপর সমাসীন’। সেটাই আমাদেরকে বলতে হবে।
ইবনু আব্দিল বার্র বলেন, ইমাম মালেককে জিজ্ঞেস করা হয়, আল্লাহ তা‘আলাকে কি ক্বিয়ামতের দিন দেখা যাবে? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, হ্যাঁ! দেখা যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وُجُوْهٌ يَّوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ، إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ ‘কোন কোন মুখমন্ডল সেদিন উজ্জবল হবে, তারা তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে’ (ক্বিয়ামাহ ২২-২৩)।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার আকার আছেন। তিনি নিরাকার নন। কারণ যার আকার আছে তাকেই দর্শন সম্ভব। কিন্তু নিরাকারকে নয়।
মহান আল্লাহ কোথায় থাকেন ?
এমন একটা প্রশ্ন আমাদের মনে অনেক সময়ই ঘুরপাক খায়। আল্লাহ আমাদের প্রভু, আমাদের একমাত্র প্রতিপালক । আমাদের সবচেয়ে আপনজন তিনি । আমরা তারই ইবাদত করি । তিনি কোথায় আছেন, কোথায় থাকেন তিনি, সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা রাখা তার একজন বান্দা হিসেবেই আমাদের জন্য জরুরি বৈ কি। বান্দা যার বন্দেগি করে, তার সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জানাশোনা না থাকলে তার বন্দেগিতে সংশয় থেকে যাওয়া বিচিত্র নয়।
১. এ ব্যাপারে কোরআন কী বলে
আল্লাহ কোথায় আছেন, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিজেই বলছেন-
الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى
অর্থাৎ, পরম করুণাময় আরশের উপর আছেন। (সুরা তাহা, আয়াত ৫)
এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
وَهُوَ اللَّهُ فِي السَّمَاوَات
অর্থাৎ আর তিনিই আল্লাহ যিনি আসমানে আছেন। (সুরা আনআম, আয়াত ৩)
এ আয়াতে জানা যায়, আল্লাহ আসমানে আছেন। তার আরশ আসমানে। কোরআনে এ-ও বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়লার ‘কুরসি’, যেখানে তিনি সমাসীন আছেন, তা আসমান ও জমিনব্যাপী বিস্তৃত । আল্লাহ তায়ালা যে আসমানে আছেন, এর সমর্থনে আরো একটি আয়াত পাওয়া যায়, সুরা নাহলে আল্লাহ তায়লা ইরশাদ করেন, ‘তারা তাদের উপরের প্রতিপালককে ভয় করে ।’ (সূরা নাহল, আয়াত ৫০)
২. হাদিসের ভাষ্য
হাদিসের দিকে তাকালেও দেখবো, আল্লাহ তায়ালা যে আসমানে আছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় রাসুলের [সা.] অনেক বাণী ও সাহাবের উক্তি থেকেও । রাসুলকে [সআ.] আল্লাহ সপ্তম আকাশের উপরে উঠিয়ে নিয়েছিলেন মেরাজের উদ্দেশ্যে । সেখানেই পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করা হয়েছিল। (বুখারী ও মুসলিম)
এক হাদিসে তিনি ইরশাদ করেন,
ارْحَمُوا مَنْ فيِ الارضِ يَرْحَمكٌمْ مَنْ في السَّمَاء
অর্থাৎ যারা জমিনে আছে তাদের প্রতি দয়া করো, তবে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। (তিরমিযি)
রাসুল [সা.] একবার এক ক্রীতদাসীকে জিজ্ঞেস করলেন, বলতো আল্লাহ কোথায়? সে বললো, আসমানে। তারপর তিনি বললেন, বলতো আমি কে? সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসুল। রাসুল [সা.] বললেন, একে মুক্ত করে দাও, কারণ সে মুমিনা । (মুসলিম)
৩. সাহাবিদের বক্তব্য
রাসুলের [সা.] সাহাবিরাও এ ব্যাপারে একই মত পোষণ করতেন । আবু বকর [রা.] বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করে (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা আসমানের উপরে জীবিত আছেন, কখনোই মৃত হবেন না। (সুনানে দারেমি)
৪. ইমামদের অভিমত
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারককে [রহ.] আল্লাহ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আসমানে আরশের উপর আছেন, সৃষ্টি হতে আলাদা হয়ে।’ অর্থাৎ তার এই উপরে থাকা সৃষ্টির থাকার মতো নয় নয়। চার মাযহাবের ইমামগণও এ ব্যাপারে একমত যে, তিনি আরশের উপর আছেন, তিনি তাঁর কোনো সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নন।
৪. আরো কিছু অভিমত
ইবনে কাসির [রহ.] বলেন, তাফসিরকারকগণ এ ব্যপারে একমত পোষণ করেন যে, জাহমিয়ারা আল্লাহ সম্বন্ধে বলে যে, আল্লাহ সর্বত্র আছেন, আল্লাহ তাআলা তাদের এ জাতীয় কথা থেকে পবিত্র ও অনেক ঊর্ধ্বে। আর আয়াতের ব্যখ্যা হলো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা আমাদের সাথে আছেন দেখার দ্বারা, শ্রবণের দ্বারা । এই আয়াতের পূর্বের ও শেষের অংশ এ কথারই প্রমাণ বহন করে । (তাফসিরে জালালাইন, ইবনে কাসির)
হাদিসে আছে, রাসুল [সা.] বলেছেন, ‘আল্লাহ আরশের উপর আছেন । তবে তোমরা কী করো বা না করো তিনি তা জানেন।’ (আবু দাউদ)
৫. মূল কথা কী?
সুস্থ বিবেকও বলে যে, আল্লাহ যদি তিনি সর্বত্রই বিরাজমান থাকেন তার সত্তাগতভাবে, তবে অবশ্যই রাসুল [সা.] তা জানতেন এবং সাহাবিদের শিক্ষা দিতেন। পৃথিবীতে অনেক অপবিত্র জায়গা আছে যেখানে তাঁর থাকার প্রশ্নই ওঠে না। আল্লাহ তায়ালার সত্তা একক ও অভিন্ন । কিন্তু সর্বত্র বলতে বহু জায়গা বুঝায় । তাকে কোনো অবস্থাতেই বহুভাগে বিভক্ত করা যায় না। সুতরাং এটাই সত্য যে, তিনি আসমানে আরশের উপর আছেন। তবে তিনি তার দেখা, শোনা ও জ্ঞানের দ্বারা সকল বিষয় সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবহিত আছেন ।
মাওলানা মনযূরুল হক
মহান আল্লাহ কোথায় থাকেন ?
এমন একটা প্রশ্ন আমাদের মনে অনেক সময়ই ঘুরপাক খায়। আল্লাহ আমাদের প্রভু, আমাদের একমাত্র প্রতিপালক । আমাদের সবচেয়ে আপনজন তিনি । আমরা তারই ইবাদত করি । তিনি কোথায় আছেন, কোথায় থাকেন তিনি, সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা রাখা তার একজন বান্দা হিসেবেই আমাদের জন্য জরুরি বৈ কি। বান্দা যার বন্দেগি করে, তার সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জানাশোনা না থাকলে তার বন্দেগিতে সংশয় থেকে যাওয়া বিচিত্র নয়।
১. এ ব্যাপারে কোরআন কী বলে
আল্লাহ কোথায় আছেন, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিজেই বলছেন-
الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى
অর্থাৎ, পরম করুণাময় আরশের উপর আছেন। (সুরা তাহা, আয়াত ৫)
এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
وَهُوَ اللَّهُ فِي السَّمَاوَات
অর্থাৎ আর তিনিই আল্লাহ যিনি আসমানে আছেন। (সুরা আনআম, আয়াত ৩)
এ আয়াতে জানা যায়, আল্লাহ আসমানে আছেন। তার আরশ আসমানে। কোরআনে এ-ও বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়লার ‘কুরসি’, যেখানে তিনি সমাসীন আছেন, তা আসমান ও জমিনব্যাপী বিস্তৃত । আল্লাহ তায়ালা যে আসমানে আছেন, এর সমর্থনে আরো একটি আয়াত পাওয়া যায়, সুরা নাহলে আল্লাহ তায়লা ইরশাদ করেন, ‘তারা তাদের উপরের প্রতিপালককে ভয় করে ।’ (সূরা নাহল, আয়াত ৫০)
২. হাদিসের ভাষ্য
হাদিসের দিকে তাকালেও দেখবো, আল্লাহ তায়ালা যে আসমানে আছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় রাসুলের [সা.] অনেক বাণী ও সাহাবের উক্তি থেকেও । রাসুলকে [সআ.] আল্লাহ সপ্তম আকাশের উপরে উঠিয়ে নিয়েছিলেন মেরাজের উদ্দেশ্যে । সেখানেই পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করা হয়েছিল। (বুখারী ও মুসলিম)
এক হাদিসে তিনি ইরশাদ করেন,
ارْحَمُوا مَنْ فيِ الارضِ يَرْحَمكٌمْ مَنْ في السَّمَاء
অর্থাৎ যারা জমিনে আছে তাদের প্রতি দয়া করো, তবে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। (তিরমিযি)
রাসুল [সা.] একবার এক ক্রীতদাসীকে জিজ্ঞেস করলেন, বলতো আল্লাহ কোথায়? সে বললো, আসমানে। তারপর তিনি বললেন, বলতো আমি কে? সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসুল। রাসুল [সা.] বললেন, একে মুক্ত করে দাও, কারণ সে মুমিনা । (মুসলিম)
৩. সাহাবিদের বক্তব্য
রাসুলের [সা.] সাহাবিরাও এ ব্যাপারে একই মত পোষণ করতেন । আবু বকর [রা.] বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করে (সে জেনে রাখুক) নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা আসমানের উপরে জীবিত আছেন, কখনোই মৃত হবেন না। (সুনানে দারেমি)
৪. ইমামদের অভিমত
আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারককে [রহ.] আল্লাহ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আসমানে আরশের উপর আছেন, সৃষ্টি হতে আলাদা হয়ে।’ অর্থাৎ তার এই উপরে থাকা সৃষ্টির থাকার মতো নয় নয়। চার মাযহাবের ইমামগণও এ ব্যাপারে একমত যে, তিনি আরশের উপর আছেন, তিনি তাঁর কোনো সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নন।
৪. আরো কিছু অভিমত
ইবনে কাসির [রহ.] বলেন, তাফসিরকারকগণ এ ব্যপারে একমত পোষণ করেন যে, জাহমিয়ারা আল্লাহ সম্বন্ধে বলে যে, আল্লাহ সর্বত্র আছেন, আল্লাহ তাআলা তাদের এ জাতীয় কথা থেকে পবিত্র ও অনেক ঊর্ধ্বে। আর আয়াতের ব্যখ্যা হলো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা আমাদের সাথে আছেন দেখার দ্বারা, শ্রবণের দ্বারা । এই আয়াতের পূর্বের ও শেষের অংশ এ কথারই প্রমাণ বহন করে । (তাফসিরে জালালাইন, ইবনে কাসির)
হাদিসে আছে, রাসুল [সা.] বলেছেন, ‘আল্লাহ আরশের উপর আছেন । তবে তোমরা কী করো বা না করো তিনি তা জানেন।’ (আবু দাউদ)
৫. মূল কথা কী?
সুস্থ বিবেকও বলে যে, আল্লাহ যদি তিনি সর্বত্রই বিরাজমান থাকেন তার সত্তাগতভাবে, তবে অবশ্যই রাসুল [সা.] তা জানতেন এবং সাহাবিদের শিক্ষা দিতেন। পৃথিবীতে অনেক অপবিত্র জায়গা আছে যেখানে তাঁর থাকার প্রশ্নই ওঠে না। আল্লাহ তায়ালার সত্তা একক ও অভিন্ন । কিন্তু সর্বত্র বলতে বহু জায়গা বুঝায় । তাকে কোনো অবস্থাতেই বহুভাগে বিভক্ত করা যায় না। সুতরাং এটাই সত্য যে, তিনি আসমানে আরশের উপর আছেন। তবে তিনি তার দেখা, শোনা ও জ্ঞানের দ্বারা সকল বিষয় সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবহিত আছেন ।
মাওলানা মনযূরুল হক
[1]. ইমাম আবু হানীফা, আল-ফিক্বহুল আবসাত, পৃঃ ৫১।
[2]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৩য় খন্ড, পৃঃ ২৭৪।
[3]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৮/১২-১৩; ইমাম আহমাদ, আর-রাদ্দু আলাল জাহমিয়্যাহ, পৃঃ ৪৯-৫১।
[4]. মাজমূঊ ফাতাওয়া ৫/১৮৮-৮৯।
[5]. মাজমূঊ ফাতাওয়া ৫/১৯১-৯৩।
[6]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৭ম খন্ড, পৃঃ ৫৬০।
[7]. উছমান বিন সাঈদ আদ-দারেমী, আর-রাদ্দু আলাল জাহমিয়্যাহ, তাহকীক : বদর বিন আব্দুল্লাহ বদর (কুয়েত : দারু ইবনিল আছীর, ২য় সংস্করণ, ১৯৯৫), পৃঃ ৪৩-৪৪।
[8]. মুসলিম, মিশকাত হা/৬৭ ‘ঈমান’ অধ্যায়।
[9]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৬৮ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কুমন্ত্রণা’ অনুচ্ছেদ।
[10]. ইনফিতার ৮২/১০-১২; তাফসীর ইবনে কাছীর, ৭ম খন্ড, পৃঃ ৪০৪।
[11]. আল-কাওয়াইদুল মুছলা ফী ছিফাতিল্লাহি ওয়া আসমায়িহিল হুসনা, পৃঃ ৭০-৭১।
[12]. ঐ।
[13]. তাফসীরে ত্বাবারী, ১৫/২৩২ পৃঃ।
[14]. তাফসীরে ত্বাবারী ১৫/২৩২ পৃঃ।
[15]. তাফসীরে ত্বাবারী ১৫/২৩২।
[16]. মা‘আলিমুত তানযীল, ৫/১৬৫।
[17]. বুখারী হা/৭৩৮৬ ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৯।
[18]. হা-মীম সাজদাহ ৪১/২২; বুখারী হা/৭৫২১ ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪১।
[19].মা‘আরিজুল কবূল ১/৩০৪।
[20]. বুখারী হা/৪৮১১, ‘তাফসীর’ অধ্যায়।
[21]. বুখারী হা/৭৪১২।
[22]. মুসলিম হা/২৭৫৯; ‘তওবা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৫।
[23]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫৭২।
[24]. মুসলিম হা/২৬৫৪ ‘ভাগ্য’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩।
[25]. বুখারী, হা/১৪১০ ‘যাকাত’ অধ্যায়।
[26]. বুখারী, হা/৩৩৪৮ ‘তাফসীর’ অধ্যায়।
[27]. বুখারী হা/৭৩৮৪ ‘তাওহীদ’ অধ্যায়।
[28]. বুখারী হা/৪৯১৯ ‘তাফসীর’ অধ্যায়।
[29]. বুখারী, হা/৩৪৩৯ ‘নবীদের কাহিনী’ অধ্যায়।
[30]. মুসলিম, হা/২৭৪৭ ‘তওবা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১।
[31]. বুখারী, হা/২৮২৬ ‘জিহাদ ও সিয়ার’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৮।
[32]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ১৪শ’ খন্ড, পৃঃ ২০০।
[33]. বুখারী হা/৭৪৩৫ ‘তাওহীদ’ অধ্যায়।
[34]. বুখারী হা/৭৪৩৭ ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৪।
[35]. মুসলিম হা/১৮১ ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৮০।
[36]. আল-ফিক্বহুল আবসাত্ব, পৃঃ ৫৬।
[37]. আল-ফিক্বহুল আকবার, পৃঃ ৩০২।
[38]. আক্বীদাতুস সালাফ আছহাবুল হাদীছ, পৃঃ ৪২; শারহুল ফিক্বহুল আকবার, পৃঃ ৬০।
[39]. আল-ফিক্বহুল আকবার, পৃঃ ৩০২।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন